- রাত তেমন হয়নি। কাল-সাঁঝি। মা বসেছে পাতখালিতে। শালপাতা সেলাইএর আওয়াজ উঠছে। ফটস ফটস। বইপত্তর মেলে চুপচাপ বসে আছি দেখে মা চিল্লায় - কই রে? - থামথুম কেনে?
আমি আরও চুপ মেরে যাই। কোনও কিছুই ভাল লাগছে না আজ।
-আমারও কি ভাল লাগে এইসব কাম! লিতই বন যাও। পাতখালি কর। হাড়মাস জল কর।
- তবে যাইস কেনে?
-তুই পড়বি হত্যেই...
মা এক খামচে পাতচাকিটা নিজের কোলের কাছে টেনে নিল। হাতে নিমকাঠি তুলে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভীষণ।
-ঠিক আছে। আজ তবে জিরান দে। আমারও খারাপ যাচ্ছে শরীরটা।
মা উঠে গেল। ভাতের হাঁড়ির উসুরপুসুর শব্দ। সকালের ডুভাখান জলঢালা ভাত সাথে এককামড় ঝাঁজি পিঁয়াজ। কী সুয়াদ। মায়ের ভাগে মাড়ের বাটি। এবং নুন মেশানো জল। এইসময় যদি মায়ের কাজটা থাকত, ধানসিদ্ধ কিংবা চালপাছড়ানোর সে কাজ দিত বাটি ভরতি গরমাগরম ভাত। সাঁঝবেলা। আহা। পা ছড়িয়ে কি আয়েস করেই না সাবাড়ে খেতাম সব।
মা ফিরে গেল শালপাতায়। আমি চাটাইএর এককোণে ছেড়ে দিলাম রোগা শরীর। ডিবরির আলো কমে এসেছে এখন। মা হাতের কৌশলে উসকে দিল সলতেটা। কেরোসিন যদিও তলানিতে। একসময় দপ করে নিভে গেল সে আলো। আঁধারে মিশে গেল মায়ের শরীর।
-মা কোথায়, কোথায় মা?
প্রথম দিকে অন্ধকারে কষ্ট হত আমার । এখন গা সওয়া। এ নিত্যদিনের। নিত্যরাতের এ অন্ধকার।
- কই রে ঘুমালিস?
-নাই মা।
-কেনে রে?
- বড় আঁধার যে।
- তবে শুন, একটা গল্প বলি। তখন এমনি এক আঁধার। সে আঁধারে আসল এক সদাগর। সেবার দমে আকাল পড়িছে। লোকজন খাতে পাচ্ছে নাই। যা ছিল রুজি। উটাও গেল জনার মুজি খাইয়ে। ধার উধার কেউ দিচ্ছে নাই। কেনে দিবেক? লোকের থাকলে তবেই না দিবেক। খরায় ধান মরল। জল নাই। পিয়াসে ছাতি ফাটছে। জিনগানি ধড়ফড়াচ্ছে। গাঁ ঘরে বুড়াঠেরা মরতে শুরু করল। দুধের শিশুও বাদ পড়ল না।
সাতভায়াদের ঘরেও সেবার ভাত নাই। সে বছরই এক ভাই বউ আনল। এতগা প্যাট খাবেক কি? এদিকে সদাগর আসল হাঁক দিয়ে - এক গৈরা টাকা লিবি গ... বহুবিটি দিবি গ...পাড়ায় পাড়ায় টাকা ছড়াচ্ছে সদাগরে। সাত ভয়াদের বহুবিটি কিনে নিল। সে টাকায় এল সদাপাতি। চাল। ডাল ।মাছ। দুধ ঘি।
-কই রে, ঘুমালিস?
-নাই। তারপর...
-এর কি শেষ আছে ব্যাটা। এ চলতেই থাকে।
-সে সদাগর কি এখনও আসে গাঁ ঘরে?
- আসে তো।
-সে কেমুন দেখতে মা?
-তার যে অনেক রূপ। অনেক বেশ। অনেক নাম।
যথারীতি সকাল হল। রোদ উঠল। রোদে শুকোবে শালপাতা। তারপর গোনাগুনতি। হাজার পটলে তেলনুন। সদাপাতি। চাল আসবে। ডাল আসবে। দুধ কি আসবে? মাছ?
এসব কিছুই এল না। এল একটা মোটর সাইকেল। তা থেকে নামল মংলা আর ধরমু দাদা।
-তর মা কই? কুথাকে গেছে?
-বলবিস মিটিং আছে। বাস আসবেক গাঁকে। কলকাতার মন্ত্রী আসছে। দিল্লির লে বড় নেতা। রবেন কই?
এখন ভরাসাঁঁঝ। বাইরে কাদের কোলাহল। হইহল্লা। ঘরের ভেতর ডুবে রয়েছে অন্ধকারে। সলতে ভেজার তেলটুকুও নেই ডিবরিতে। আমি ডুবে যাই। গতকালের সওদাগরের গল্পে।
-সে কেমুন দেখতে মা?
-তার কী একটা রূপ? সে যে অনেক।
-অনেক? তবে চিনব কেমুনে?
-অন্ধকার তার পথ। অন্ধকারে সে গাঁয়ে আসে।
।। প্রকাশিত - দেখা গল্প পত্রিকা। ।
প্রকাশকাল -১৯ শে মে। ২০১৯।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন